Yavuz : Race to The Throne

 


"সাহসিকতা বিজয়ের দিকে নিয়ে যায়, সিদ্ধান্তহীনতা বিপদে ধাবিত করে, আর কাপুরুষতা মৃত্যু ডেকে আনে"

সিংহাসনে আহরনের পর পিতা ও ভাইদের উদ্দেশ্যে উক্ত কথা বলেছিলেন ইয়াভুজ সুলতান সেলিম খান। আমাদের রাষ্ট্রসহ বেশ কিছু জাতির মধ্যেই ইয়াভুজ সুলতান সেলিম খানকে নিয়ে অনেক রকম নেতিবাচক ভাবনা রয়েছে মানুষের। বিক্রিত সব সিরিজের প্রভাবে জনগনের কাছে তিনি আজ হিংস্র নামেও পরিচিত। তবে আজ আমরা ইয়াভুজ সেলিমের সিংহাসনে আহরনের আসল ঘটনা জানবো।

তখন সুলতান দ্বিতীয় বেয়াজিদের রাজত্বের ২৮ বছর চলছে, তার শাসক জীবনের শেষের দিক, সাল ১৫০৯। এক ভয়াবহ ভূমিকম্পের প্রকোপে কেপে ওঠে সমস্ত ইস্তানবুল। ইতিহাসবিদেরা একে কিয়ামত-ই সুগরা বলে থাকেন। এই ভূমিকম্পের কারনে ইস্তানবুল অকেজো হয়ে উঠলে সুলতান এদির্নেতে চলে যায়। জনগণ সহ নানা গুরু,পন্ডিত ও দার্শনিকেরা একে সুলতান দ্বিতীয় বেয়াজিদের নানা ভুলের শাস্তি খোদার পক্ষথেকে প্রেরন করা মনে করেন। ঠিক ঐ বছরেই উসমানীয়দের দীর্ঘসময়ের শত্রু কারামানদের সর্বদার জন্য পরাজিত করে কারামানলিক জয় করে নেন তার প্রিয় পুত্র শাহাজাদা আহমেদ। এই মহান বিজয় উদযাপন করতে শাহাজাদা আহমেদ খালি থাকা রাজধানী ইস্তানবুলের দিকে অগ্রসর হয়। 

প্রথমেই শাহাজাদা আহমেদ ছিলেন সুলতানের প্রিয় পুত্র তার ওপর উক্ত বিজয়ের ফলে সে হয়ে উঠেছিলেন সকলের নজরে সিংহাসনের একমাত্র উত্তস্বরী। এই বিষয় বিচলিত করে তোলে ছোট শাহাজাদা সেলিমকে। কেননা উসমানীয় সম্রাজ্যের নীতিতে সুলতান সিংহাসনে আহরনের পরই সর্বপ্রথম নিজ ভাইদের হত্যার আদেশ দেয়। আহমেদের উক্ত বিজয় লোককে ইয়াভুজ সেলিমের পারস্যের বিরুদ্ধে অর্জন করা সকল বিজয় ভুলিয়ে দিয়েছিল। তৎকালীন সময়ে সুলতান দ্বিতীয় বেয়াজিদের আরো একটি ছেলে জীবিত ছিল। শাহাজাদা কোর্কুত, তাকে মানিসা বা সারুহান সাঞ্জাক থেকে সরিয়ে তার পিতা দুরের এক সাঞ্জাকে প্রেরন করেন। যা তাকেও করে তোলে বিচলিত। অপরদিকে শাহাজাদা আহমেদের সিংহাসনের যোগ্য উত্তস্বরী হওয়ার খবর ছড়িয়ে পরেছিল পুরো সম্রাজ্যে। তাই কোর্কুত হজের কথা বলে মামলুক সম্রাজ্যে পলায়ন করে। মামলুকেরা তাকে স্বাগতম জানিয়ে বন্ধুত্ব করলে সে ফিরে আসে ইস্তানবুলে। পিতা তাকে ক্ষমার নজরে দেখে, অপরদিকে সে উজিরদের সঙ্গে পিতার পরে সিংহাসনে আহরনের বিষয়ে আলাপ করলে উজিররা তাকে সমর্থন করে না। যার ফলে গৃহযুদ্ধ হওয়ার আগেই সে সরে যায় সিংহাসনের প্রতিযোগিতা থেকে।

একদিকে শাহাজাদা কোর্কুত ছিল মৃত দাদা সুলতান মুহম্মদ আল ফাতিহ এর নজরে যোগ্য উত্তস্বরী আর আহমেদ ছিল পিতা বেয়াজিদের নজরে যোগ্য উত্তস্বরী। এই সব বিষয় বিবেচনাত একা হয় পরেন শাহজাদা সেলিম। উসমানীয় সম্রাজ্যের সুলতান হবার রীতি অনুযায়ী যে শাহাজাদা রাজধানীর কাছের সাঞ্জাকে থাকবে তারই সুলতান হওয়ার সুযোগ বেশি। 

শাহাজাদা সেলিমের ছেলে শাহাজাদা সুলেমান সেই সময় ছিল ইস্তানবুলের সবচেয়ে কাছের সাঞ্জাক "বলু"-এর সাঞ্জাক বে হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। যা চিন্তায় ফেলে শাহাজাদা আহমেদকে, আর সে সুলতানকে বলে শাহাজাদা সুলেমানকে ক্রিমিয়ার সন্নিকটে এক দুরের সাঞ্জাকে প্রেরন করেন। আর নিজে ইস্তানবুলের কাছে অবস্থান নেন। শাহাজাদা সেলিম রুমেলিয়া অঞ্চলে কোনো এক সাঞ্জাকে আসতে চাইলে তাকে নিষেধ করে দেন সুলতান দ্বিতীয় বেয়াজিদ। একের পর এক ব্যাপারে যোগ্য হওয়ার পরও বঞ্চিত থাকায় সেলিম এইবার রাগান্বিত হয়ে ওঠেন। আর বিশাল এক ৩০ হাজার সৈন্যের বাহিনী গঠন করে থ্রেস অঞ্চলে বিদ্রোহ সৃষ্টি করেন।

Shehzade Yavuz Selim's Revolt Against Father Sultan Beyazit II

সেই বিদ্রোহে ৪০ হাজার সৈন্যসহ দমন করতে হাজির হয় সুলতান দ্বিতীয় বেয়াজিদ। ঠিক ওই একই সময়ে আবার পারস্যের শাহকুলু বিদ্রোহের তৈরি হয় টেকে অঞ্চলে। যা দমন করতে সুলতান বেয়াজিদ তার শাহাজাদা আহমেদকে প্রেরন করেন।

একদিকে পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ১৫১১ সালে শ্বশুর বাড়ি ক্রিমিয়ান খানাতে পলায়ন করেন শাহাজাদা সেলিম। আরেকদিকে শাহকুলু বিদ্রোহ দমনের পর শাহাজাদা আহমেদকে ভবিষ্যৎ সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন সুলতান দ্বিতীয় বেয়াজিদ।

কিন্তু ভবিষ্যৎ সুলতান উপাধিতে খুসি হননি সুলতানের প্রিয় শাহাজাদা আহমেদ।বরং সে কোনিয়া দখল করে নিয়ে, নিজেকে আনাতোলিয়ার স্বাধীন সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন শাহাজাদা আহমেদ। এই বিষয় থামাতে সুলতান বেয়াজিদ শাহাজাদা আহমেদকে নিজ সাঞ্জাকে ফিরে যেতে বললে শাহাজাদা আহমেদ রাজধানী দখলের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয়। তবে সুলতানের বিশাল সৈন্যবহরের প্রহরায় রাজধানীতে প্রবেশে ব্যর্থ হয় শাহাজাদা আহমেদ।

Sultan Yavuz Selim's Ascension to the Throne.

পরের বছরের মধ্যে ১৫১২ সালে শাহাজাদা সেলিম জেনিচারীদের বিশাল এক বাহিনী আর ক্রিমিয়ান খানাতের সাহায্য নিয়ে পুনরায় আক্রমন করে জোড়পূর্বক তার অপারক পিতাকে সিংহাসনচ্যুত করে উসমানীয় সম্রাজ্যের ৯ম সুলতান হিসেবে আহোরন করেন। আর পিতাকে সম্মানের সাথে দুরের ডেমোটিকা সাঞ্জাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন। যেখানে সাবেক সুলতান দ্বিতীয় বেয়াজিদ ইন্তিকাল করেন। সিংহাসনে আহরন করে ইয়াভুজ সেলিম সকলের উদ্দেশ্যে এক মহান উক্তি বলেছিলেন "যে সাহসিকতার বলে বাচতে পারে না, তার মৃত্যু বন্দীদশায় হয়ে থাকে "

শাহাজাদা কোর্কুত শান্তি স্থাপন করে তার ছোট ভাই সেলিমকে সুলতান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে। অপরদিকে শাহাজাদা আহমেদ আনাতোলিয়ায় নিজের শাসন জারি রাখে। যা সম্রাজ্যকে রুমেলিয়া ও আনাতোলিয়া দুই সম্রাজ্যে ভাগ করে দিয়েছিলো। তখন সমাধান হিসেবে ২৪ এপ্রিল,১৫১৩ সালে  ইয়েনিহিসারের কাছে সুলতান (স্ব-ঘোষিত) আহমেদ আর সুলতান ইয়াভুজ সেলিমের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যেখানে পরাজিত হয়ে বন্দী হয় শাহাজাদা আহমেদ এবং পরে তাকে হত্যা করা হয়। আর অন্যদিকে শাহাজাদা আহমেদের পুত্র শাহাজাদা মুরাদ তার চাচার চিরশত্রু সাফাভী সম্রজ্যের শাহ ঈসমাইলের কাছে আশ্রয় নেয়। 

Yavuz Selim Battle.

অবশিষ্ট ভাই শাহাজাদা কোর্কুতকে সুলতান ইয়াভুজ সেলিম বেচে থাকার সুযোগ দিয়ে কয়েকটি জাল শত্রুপক্ষের চিঠি পাঠিয়ে পরীক্ষা করে। সে পরীক্ষায় ফেসে যায় শাহাজাদা কোর্কুত আর বিদ্রোহ করতে চাওয়ার শাস্তি হিসেবে তাকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে সম্রাজ্যে একচ্ছত্র আধিপত্যের খুটি স্থাপন করেন সুলতান ইয়াভুজ সেলিম। 

Brother Fratriciding in Ottoman Empire.

যেখানে সে সর্বকনিষ্ঠ শাহাজাদা, তার পক্ষে কেউ নেই, সেখানে শাহাজাদা থেকে সুলতান হয়ে ইয়াভুজ সেলিম তার যোগ্যতার প্রমান করেছিলেন। লোকে তাকে যা-ই বলে ইতিহাস সর্বদা তার সাহসিকতা এবং ইচ্ছার প্রতি অদম্যতা সম্মানের সঙ্গে স্মরন করবে। ধন্যবাদ।


Source :

1. "Osman's Dream" by Caroline Frinkle

2. "Uc kitanin Sultan Yavuz Selim" by Yavuz Bahadiroglu

3. " Encyclopedia of Ottoman Empire " By Gabor Agoston.